ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ হোক

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী
(একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দ সৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

 

আমাদের ছোটবেলায় অগ্রজদের সামনে অনুজরা ধূমপান বা নেশাজাত দ্রব্য সেবন করতো না। মূলত সেই সময়ে সমাজে কালচার ছিলো যে, বড়দের সামনে ধূমপান করা চরম বেয়াদবী। আড়ালে-আবডালে সিগারেট সেবনের পরেও হঠাৎ বড়দের সামনে পড়ে যাওয়া, সেটা আলাদা বিষয় ছিলো। তখন সেটা হয় ফেলে দিতো, নতুবা আড়াল করে রাখতো। বড়দের সম্মানে ধূমপানরত ব্যক্তি সিগারেট আড়াল করতে গিয়ে হাত পুড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটতো। সভ্য সমাজে পারিবারিক শিক্ষা ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষের থেকে এমন আচরণ আকাঙ্খিত। কিন্তু, বর্তমানে আমাদের অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। সামাজিক রীতি-নীতির চরম অবক্ষয়ের কারণে অনেক সামাজিক ও পারিবারিক শিষ্টাচার অবলীলায় লঙ্ঘণ করতে দেখা যাচ্ছে। ‘ধূমপান’ শিষ্টাচার লঙ্ঘণের প্রক্রিয়া উস্কে দিচ্ছে।

সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ২০১৭ সালের তথ্য মতে, দেশে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। এর সাথে আরো একটা অংশ রয়েছে যারা এই গণনার বাইরে। অর্থাৎ- শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদ অভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্নক অশনিসংকেত! বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত ÒGlobal School Based Student Health Survey-2014Ó গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)!

কৌতুহূল কিংবা প্ররোচনায় যে শিশু-কিশোরটি ধূমপান দিয়ে নেশার জগতে পা রাখছে, জীবনে সাফল্যের পথকে পায়ে ঠেলে বিপথগামী হচ্ছে, তার জন্য কে বা কারা দায়ী? আমরা তার খোঁজ রাখছি না। মূলত, এর জন্য দায়ী মৃত্যু বিপণনকারী তামাক কোম্পানিগুলো। এরা কৌশলে বিজ্ঞাপন ও নানান প্রলোভনে তামাকের মাধ্যমে আমাদের শিশু-কিশোরদের ক্ষতিকর নেশার জগতে ঠেলে দিচ্ছে।

আজকের দিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সবাই কম-বেশি রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। উল্লেখ্য যে, এসব যায়গায় ইদানিংকালে তরুণদের যাতায়াত তুলনামূলক বেড়েছে। যা ‘সুযোগ’ হিসেবে ব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। তরুণদের কাছে জনপ্রিয় এসব রেস্টুরেন্টে কোম্পানিগুলো স্পন্সরের মাধ্যমে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ’Designated Smoking Zone’ তৈরী করে দিচ্ছে। এসকল স্থানে তামাকের বিজ্ঞাপনও প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে খাবার ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সময় কাটানোর স্থান সেখানে ধূমপানের স্থান রাখায় সেখানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে না। কারণ, অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ আশে-পাশের স্থানকে সুরক্ষিত রাখছে না। ধূমপানের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে আশে-পাশে। ফলে পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী, শিশু ও অধূমপায়ীরা।

গ্লোব্যাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭ তে দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭ শতাংশ, গণপরিবহনে প্রায় ৪৪ শতাংশ এবং ৪৯.৭ শতাংশ মানুষ রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এই সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬১,০০০ শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লক্ষ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) অনুসারে আমাদের দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রনীত হয়েছে। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। এফসিটিসি’র ধারা ৮ ও এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

২০০৫ সালে প্রণীত (২০১৩ সালে সংশোধিত) ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ অনুসারে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। তবে কিছু পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে (ট্রেন, স্টিমার ইত্যাদি) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ’Designated Smoking Zone’ রাখার কথা বলা হয়েছে। যা তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ, জনবহুল পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থান পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর প্রধান শিকার নারী ও শিশুরা। উপরন্ত, অধূমপায়ী এবং এসব স্থানে সেবা প্রদানকারী সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছের। কারণ গবেষণা বলছে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশপাশের স্থান কখনই ধোঁয়ামুক্ত হয় না। এই তামাকের ধোঁয়ায় ৭০০০ এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, পরোক্ষ ধূমপান অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ। শিশুদের ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোম রোগেরও কারণ পরোক্ষ ধূমপান। পক্ষান্তরে, কর্মক্ষেত্র, রেস্তোরাঁসহ সকল পাবলিক প্লেসকে ১০০% ধূমপানমুক্ত করা সম্ভব হলে কর্মীদের হৃদরোগে আক্রান্তের ঝুঁকি ৮৫ % হ্রাস পায়। এই মানুষগুলোর শ^াসতন্ত্র ভালো থাকে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যায়। ধূমপানমুক্ত পরিবেশে ধূমপায়ী কর্মীর সিগারেট সেবনের মাত্রা দিনে গড়ে ২ থেকে ৪টা পর্যন্ত হ্রাস পায় যা গবেষণায় প্রমাণিত।

এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানমুক্ত সাইনেজে “ধূমপান হইতে বিরত থাকুন, ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ” বার্তা উল্লেখ আছে। শাস্তিযোগ্য অপরাধ যে কোন স্থানেই উচিৎ নয়, তা সংঘটিত হোক, যেটা কারোরই কাম্য নয়। সুতরাং, ধূমপানের জন্য জনবহুল স্থানে আলাদা করে স্থান বরাদ্দ করতে হবে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা হোক। এতে ধূমপায়ীরা ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হতে পাওে এবং সুরক্ষিত থাকবে অধূমপায়ীরা।

সার্বিক দিক বিবেচনায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি অধিকতর শক্তিশালী করার মাধ্যমে পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ীদেরকে রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। যা অত্যন্ত প্রসংশনীয় উদ্যোগ। তবে, বিশে^ এটি নতুন নয় বরং আমরাই এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছি। বিশ্বে ৬৯টি দেশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেসে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বিমানবন্দরে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৪২টি দেশে। তাও ভালো আমরা এ পর্যায়ে এসে শুরু করতে পেরেছি। এখন এই প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন এবং বাস্তবায়নে যেতে হবে। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেখতে চান।

ধূমপায়ীদের ধুমপান হতে বিরত রাখতে ‘শতভাগ ধূমপানমুক্ত স্থান একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তাই পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করতে হবে। এজন্য বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের (ধারা ৭ ও ৭ক) বিলুপ্ত করা উচিৎ। এতে করে প্রধানমন্ত্রী’র ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণা বাস্তবায়ন ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা পাবে। যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্বাস্থ্যখাতে অসংক্রামক রোগের চাপ ও চিকিসা ব্যয় কমাবে। আগামী প্রজন্ম হবে সুস্বাস্থ ও সুনাগরিকের গুণাবলী সম্পন্ন দক্ষ ও কর্মক্ষম জনবল। যারা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

 

__________________________________________________________

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী,

একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দ সৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)
সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন বোর্ড (স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়) এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স কমিটি (স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়)
সাম্মানিক জেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারী, বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
ইমেইল: [email protected]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *